▶প্রশ্নঃ জন্ম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ইসলাম কী বলে? অনেকে এ বিষয়টাকে নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ায়। - সুমাইয়া তানজিম, কুমিল্লা থেকে।
উত্তরঃ জন্ম নিয়ন্ত্রণ যে খুব একটা ভালো কাজ তা কিন্তু নয়। এটা আমারা সবাই বুঝি। পৃথিবীতে আজ আপনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এবং তা উপভোগ করছেন। আপনি কি জানেন, পরিবার পরিকল্পনার ফল সরূপ যদি আপনার বাবা-মা আপনাকে conceive না করতো। তাহলে আপনি কখনোই এই দুনিয়ায় আসতে পারতেন না। আপনি যে আজ এত বড়, তা ওই সময় আপনার বাবা মার জন্ম নিয়ন্ত্রণ না করার ফল। সুতরাং আপনি কেন চাইবেন! এমনিই আরেকটি জীবন এই পৃথিবীতে না আসার আগেই বিনাশ হয়ে যাক।
(আশা করি নাস্তিকদের পক্ষ থেকে এ নিয়ে আপত্তি আসবে না। এতটুকু আশা তো আমরা করতেই পারি।কারণ আপনারা তো মানবতার এড দিয়ে বেড়ান। যদিও এই ধরনের ক্রাইসিসে এসে মানবতার 'ম' ও মনে থাকে না। ধর্মের বিরোধিতাই তখন মূখ্য হয়ে যায়।)
তবে সমস্যা মানুষেরই থাকে। বিভিন্ন কারণে অনেক সময় এটা করতে হয়। এবং ইসলামেও এটার বৈধতা আছে। তবে অবশ্যই কিছু লিমিটেইশনের সাথে।
১/ স্থায়ীভাবে জন্ম নিয়ন্ত্রণ করা ইসলামে সম্পুর্ণ নিষিদ্ধ। কারণ এটা একটি আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতা। এটা আপনার কাছে অর্পিত আমানত মাত্র। এটা অর্জিত হওয়ার পিছনে আপনার বিন্দুমাত্রও হাত নেই। অতএব চিরকালের জন্য নষ্ট করার রাইটও আপনার নেই। যেমন আত্মহত্যা করার রাইট কারো নেই। সমস্যা হলে, অবশ্যই তার অনুরূপ সমাধানও থাকবে। কিন্তু মাথা ব্যথার কারণে পুরো মাথা কেটে ফেলার রাইট ইসলাম দেয় না।
২/ দরিদ্রতার ভয়ে কোন প্রাণ বিনাশ ইসলামে সম্পুর্ণ নিষিদ্ধ। এ ব্যপারে আল্লাহর সরাসরি নিষেধাজ্ঞা, 'তোমরা দরিদ্রতার ভয়ে তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করো না'
(বনী ঈসরাঈল-৩১)
এটা শুধু আল্লাহ না, কোন মানবিক রাজার পক্ষেও মেনে নেওয়া অসম্ভব। আর আল্লাহ তো রব্বুল আলামীন। আল্লাহ এই দরিদ্রতা ঘুচানোর জন্য যাকাতের ব্যবস্থা করেছেন। এটা এমন একটা ব্যবস্থা, যা একাই একটা রাষ্ট্রের দরিদ্রতা ঘুচিয়ে সাম্যাবস্থা সৃষ্টি করতে সক্ষম। ইতিহাস এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কিন্তু আফসোস ইসলামি আইন না থাকায় এখন ২% লোকও ঠিকমত তা আদায় করে না।
এই দুই অবস্থা ছাড়া অন্যান্য গ্রহণযোগ্য কারণের ভিত্তিতে জন্ম নিয়ন্ত্রণ বৈধ।
◼ কী কী কারণে পরিবার পরিকল্পনা নেওয়া হয়, তার একটা যৌক্তিক পর্যালোচনা।
▶স্বাস্থ্য জনিত কোন প্রব্লেমের কারণে।
▶ জন্ম নিয়ন্ত্রণ না করলে অভাবী লোক আরও অভাবী হয়ে যাবে। অর্থাৎ দরিদ্রতার ভয়ে।
▶অধিক জনসংখ্যা ঝুঁকির কারণে।
▶সন্তানকে ভালো করে মানুষ করার জন্য।
১/ স্বাস্থ্য জনিত কোন সমস্যার কারণে যদি জন্ম নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহলে অবশ্যই ইসলাম সর্বাবস্থায় তাকে জন্ম নিয়ন্ত্রণের অনুমতি দেয়। কেননা আল্লাহ কারো সাধ্যের বাহিরে কোন কিছু চাপিয়ে দেন না। (আল আনআম ১৫২)
২/ জন্ম নিয়ন্ত্রণ না করলে অভাবী লোক আরও অভাবী হয়ে যাবে। শুনতে যৌক্তিক মনে হলেও ব্যপারটিতে একটু ঘাপলা আছে। একজনের দোষ আরেকজনের উপর চাপিয়ে দেয়ার মতো। যেমন, 'অনেক টাকা-পয়সা ছেলেটাকে নষ্ট করে দিল' এরূপ কথাবার্তা আমরা প্রায়ই বলে থাকি। কিন্তু আসল ব্যপারটি এরকম নয়।টাকা-পয়সার কারণে মূলত ছেলেটি নষ্ট হই নি। টাকা- পয়সা তো অনেকের কাছেই থাকে। তারা সবাই কি নষ্ট হয়? নষ্ট হয়েছে দীর্ঘ খারাপ সঙ্গ, আবশ্যকীয় গাইডলাইনের অভাব ইত্যাদি কারণে। কিন্তু শেষমেশ দোষটা আমরা বেচারা টাকা-পয়সার উপরই দিয়ে থাকি।
ঠিক অনুরূপ অভাবী হওয়ার দোষটাও আমরা নবাগত শিশুর উপর দিয়ে থাকি। মূলত তার অভাবী হওয়ার বা অভাবী থাকার কারণ হচ্ছে অন্যকিছু।যেমন কর্মক্ষেত্রে ভুল প্লানিং, অলসতা, কারো আবার নেশা-জুয়ার মতো বদ অভ্যাস ইত্যাদি। ছেলেটিকে গাইডলাইন ও ভালো সঙ্গের ব্যবস্থা না করে, শুধু টাকা- পয়সা না দিলেই যেমন সমস্যার সমাধান হত না। ঠিক তেমনই বাকি সমস্যা ব্যতিরেকে জন্ম নিয়ন্ত্রণও কোন সমাধান না।
সর্বনিম্ন শ্রেণীর একজন মানুষ, 'রিক্সাওলা, ঠেলাওয়ালা' তারাও কমসেকম দিনে চার -পাঁচশ এবং মাসে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা অনায়াসে কামায়। যা দিয়ে সাধারণ একটি পরিবার খুব ভালো ভাবেই চলতে পারে। খুব স্বাভাবিক একটা বাস্তবতা হলো অধিকাংশ সাধারণ মানুষেরই কোন প্লানিং থাকে না। তারা দিন আনে দিন খায়। তাদের ইনকামটা হয় কিছুটা অপরিহার্য খোরপোশের উপর ভিত্তি করে। এটা কম-বেশি যতই হোক না কেন, দেখা যায় দিন শেষে টার্গেট অবদি পৌঁছেই আত্মতৃপ্তিতে সে হাঁপিয়ে যায়। আল্লাহ ঠিকই তার কাঙ্ক্ষিত বস্তু তাকে পাইয়ে দেয়।কিন্তু বিভিন্ন নেশা, জুয়া বদ অভ্যাস ইত্যাদি মানুষকে দরিদ্রতার চাদর থেকে বের হতে দেয় না।
একাধিক সন্তান নেয়ার কারণে যদি মানুষ অভাবী হয়ে থাকে। তাহলে তো এমন লোকও আছে। যে একটা সন্তানও কেরী করতে পারবে না। তবে কি সে, সন্তান নিবে না। যদি নাই নেয়, তাহলে বৃদ্ধ বয়সে এই মা-বাবার সব দায়িত্ব নেবে কে? একাধিক সন্তান না নেওয়াই কি অভাব দূর হওয়ার কারণ, নাকি নেওয়াটা সম্ভাবনার
হাতছানি?
৩/ অধিক জনসংখ্যা ঝুঁকির কারণ। এ কথাটি চিন্তার সীমাবদ্ধতার ফল সরূপ। অনেক সম্পদ কখনো দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে। তাই বলে সম্পদ জমা করাটা দোষের মটেও না। বরং এটা সম্পদ জমাকারীর অক্ষমতা। তদ্রূপ কোন সরকার যদি বলে অধিক জনসংখ্যা উক্ত দেশের জন্য অভিশাপ। সেটা হতে পারে।
তবে বুঝতে হবে, দোষটা জনসংখ্যার মটেই নয়। বরং সেই সরকার দেশের জনশক্তিকে কাজে লাগাতে অক্ষম।
আজ জনশক্তিকে কাজে লাগাতে পেরেছে চীন।
তাদের কাছে জনগণ অভিশাপ নয়, বরং আশীর্বাদ। এজন্যই আগামী সুপার পাওয়ার এর গণনা তাদেরই দখলে।
আর শুধু তারাই নয় আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা,রাশিয়া ইত্যাদি প্রত্যেকটি সফল দেশও বুঝে জনগণের কদর। তাই তারা তাদের জনগণকে নানাভাবে অনুৎসাহিত নয়, উৎসাহিত করছে।
প্রশ্ন আসতে পারে, 'দেশ অপেক্ষা তাদের জনসংখ্যা কম তাই তারা জনসংখ্যা বাড়াতে উৎসাহিত করে।' তাহলে আমি বলবো, আপনার ধারণা ভুল। তাদের জনসংখ্যা আমাদের দেশের তুলনায় কম। তবে কম জনসংখ্যা নিয়ে যেমন দেশ অামরা অাকাঙ্ক্ষা করি, তার চেয়েও কম না। কিন্তু কম জনসংখ্যা নিয়েও যারা সফল, তারা জনসংখ্যা বাড়াতে চাচ্ছে কেন ? এভাবে চলতে থাকলে একদিন তো তারাও জন সংখ্যার ঝুঁকিতে পড়বে। তাহলে আগে থেকেই কেন তারা সতর্ক হয়ে যাচ্ছে না। প্রাকৃতিক ভাবেই তো জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাহলে ঢাকঢোল পিটিয়ে উৎসাহিত করে বিপদ ডেকে আনার মাঝে কী হিকমত কী প্রজ্ঞা?
আবার কেউ বলতে পারেন, জনসংখ্যা বেড়ে গেলে খাদ্য, জায়গার সংকট দেখা দিবে। তাকে আমি বলবো। আপনি বর্তমানের চোখ দিয়ে ভবিষ্যৎ দেখার চেষ্টা করছেন। জায়গার কথা বলার প্রয়োজন মনে করছি না। কারণ বাংলাদেশের জায়গার ধারণাই নেই আপনার। এরপর আবার মানুষ আকাশ-পাতাল উভয়ইকে নিজের বশীভূত করে ফেলছে। খাদ্যের ব্যাপারে খুব সংক্ষেপে বলছি। একশো বছর পূর্বে এক একোর জমিতে কতটুকু চাষ হতো আর এখন কতটুকু হয় সে সম্মন্ধে আপনার কোন ধারণা আছে? কেন এই উন্নতি, কেন এই অগ্রগতি? প্রয়োজনের তাগিদে। প্রয়োজনের তাগিদে মানুষকে অসম্ভবকে সম্ভব করার ক্ষমতা দিয়েছে স্রষ্টা। ফলে তীব্র প্রয়োজন বোধ থেকেই মানুষ আবিষ্কার করে ফেলছে অভীষ্ট তত্ত্ব। অতএব চিন্তার পরিধিকে বাধন মুক্ত করুন।
৪/ সন্তানকে ভালো করে মানুষ করা, তাকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি বানানোর জন্য অনেকে জন্ম নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। এক সন্তানের পর সাথে সাথে আরেক সন্তান লালনপালনে অস্বস্তিবোধ করলে আপনি গ্যাপ নিতে পারেন সুবিধা মতো। তবে স্থায়ীভাবে জন্ম নিয়ন্ত্রণের তো প্রয়োজন নেই। আর ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ক্ষেত্রে একমাত্র সন্তান হওয়ার কোন শর্ত বাঁধা নেই। এটা আমাদের নিছক দৃষ্টিভঙ্গি। যা করলেই হয়, না করলে নয়।
কেননা অধিকাংশ নোবেল বিজয়ীদেরকে দেখুন, তারা সবাই কি বাবা মার একমাত্র সন্তান ছিল?
না। কেউ দ্বিতীয় কেউ তৃতীয় কেউ আবার চতুর্থ, পঞ্চম। সুতরাং আপনার দৃষ্টিভঙ্গি বদলান, সবকিছু এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে।
সত্যমনা লেখক-
Robiul islam.
COMMENTS