এই নিয়ে মোরশেদ সাহেবের কপালে চিন্তার ভাজ পরেছে। শিউলি তার একমাত্র মেয়ে। মেয়ের বিয়ে নিয়ে তার মনে কত আশা, কত স্বপ্ন। বিয়ের পর মেয়ে - জামাই তার বাড়িতে আসবে। মোরশেদ সাহেব পুকুরে জাল ফেলে বড় সাইজের একটা রুই মাছ নিয়ে এসে সালেহা বেগমকে দিয়ে বলবেন, শিউলির মা মাছটা ভালো করে রান্না করবা। মাছের মাথাটা জামাইকে দিবা।
সালেহা বেগম মাছের বড় মাথাখানি জামাইর পাতে তুলে দিবেন। মেয়ের জামাই লাজুক ভঙ্গিতে বলবে, কি দরকার ছিলো এসবের! বলেই সে মাছের মাথাটি খেতে শুরু করবে। মোরশেদ সাহেব একটু দূরে একটি চেয়ারে বসে সেই দৃশ্য চেয়ে চেয়ে দেখবেন। তার মনটা তৃপ্তিতে ভরে যাবে।
মোরশেদ সাহেবের এমন চাওয়াটা নিশ্চয়ই বেশি কিছু নয়। কিন্তু বিয়েতে শিউলির সম্মতি না পাওয়াটা চিন্তার কারন হয়ে দাড়িয়েছে।
সকাল থেকে সালেহা বেগম মেয়েকে বুঝাতে বুঝাতে ব্যার্থ আর ক্লান্ত হয়েছেন। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সাথে যোগ হয়েছে নিরাশা। স্বামীর কাছে এসে দুঃখিত গলায় বলছেন, মেয়েটারে শহরে পড়তে দেওয়াটাই কাল হয়েছে। আমার মেয়ে এমন ছিলো না। শহরের পরিবেশ মেয়েটার মাথা নষ্ট করে দিছে।
মোরশেদ সাহেব স্ত্রীকে ধমক দিলেন।
- মূর্খের মতো কথা বইলো না। তোমার ছোট ভাই এর বউ , সেওতো শহরের মেয়ে। ছোট থেকে ঢাকায় বড় হয়েছে। পড়ালেখা করতে বিদেশেও গেছে। কই সেতো এমন হয়ে যায় নি। বিদেশ ফেরত একজন ডাক্তার মেয়ে এই গ্রামের বউ হয়ে সংসার করছে৷ এই মেয়েটা নষ্ট হতে পারলো না? আসল দোষ হইলো সঙ্গ। তোমার মেয়ের খারাপ সঙ্গীরাই তার মাথায় বদ চিন্তা ঢুকিয়ে দিয়েছে।
সালেহা বেগম স্বামীর কথার জবাব দিলেন না।
শাড়ির আচলখানি মুখে গুজে কান্না আটকাতে ব্যস্ত হলেন।
মোরশেদ সাহেব ঘড়ি দিকে তাকালেন৷ বেলা প্রায় দশটা। শিউলির ছোট মামিকে নয়টার মধ্যে আসতে বলা হয়েছিলো। বেলা হয়ে গেলো দশটা। প্রায় একঘন্টা লেট। মীরা এখনো আসলো না। এই নিয়ে তিনি খানিকটা বিরক্ত৷ এমন নয় যে, তাদের বাড়ির দূরত্বটা অনেক বেশি।তার ছোট শালা নিজের ডাক্তার বউ মীরাকে নিয়ে কাছেই থাকে। সেখান থেকে তাদের বাড়িতে আসতে সর্বোচ্চ মিনিট বিশেকের পথ। মীরাকে খবর দেয়া হয়েছিলো এখানে এসে শিউলিকে একটু বোঝাবার জন্য। মোরশেধ সাহেবের বিশ্বাস মীরার মত একজন আধুনিক মেয়ে যদি শিউলিকে ভালোমতো বোঝায় তাহলে বিয়েতে হয়তো মেয়েটা রাজি হয়ে যাবে।
শিউলির জন্য যে ছেলেটা ঠিক করা হয়েছে তার নাম মো খায়রুল ইসলাম। এমন ছেলে আজকালকার দিনে হরহামেশাই পাওয়া যায় না। খায়রুলের বাবা বেচে নেই। মা আছে। বড় দুই ভাই বিয়ে করে নিজদের মত করে সংসার করছে। তাদের অর্থ বিত্তের কোন কমতি নেই। কিন্তু এতসব অর্থবিত্তের বাইরেও খায়রুলের শিক্ষার গুন, নম্রতা ভদ্রতা আলাদা করে মোরশেদ সাহেবের নজর কেড়েছে। এমন একটা ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে পারলে তিনি পরম নিশ্চিন্ত হতে পারতেন।
মোরশেদ সাহেব আরেকবার নিজের হাত ঘড়ির দিকে তাকালেন। ঘড়ির কাটা দশটার ঘর পেরিয়ে গেছে। মীরা এখনো এলো না। এই নিয়ে তার মেজাজটা ধীরে ধীরে খিটখিটে হতে শুরু করেছে।
মীরা আসলো সাড়ে দশটার একটু পরে। সে নিজের স্বামী সংসার নিয়ে গ্রামে থাকলেও প্রতি সপ্তাহের তিনদিন তাকে ঢাকা যেতে হয়। মীরা ঢাকার একটি বড় হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট। সপ্তাহের সোম মঙ্গল বুধ এই তিন দিন মীরা নিজের চেম্বারে রোগী দেখে।
ছোট মামিকে দেখেই শিউলি মুখখানিকে আরেকটু বাকা করে নিজের গাম্ভীর্যতাকে আরেকটু বাড়িয়ে দিলো। সেটা চোখে পড়লো মীরার৷ সে কাছে গিয়ে পাশে বসলো। শিউলির হাতখানি ধরে বললো,
একি অবস্থা করেছো শরীরের! এই বয়সী মেয়েদের এত দূর্বল হলে চলে?
শিউলি কঠিন গলায় বললো, চলবে না কেন? ঢের চলবে?
মীরা অল্প হেসে বললো, এই বয়সেই যদি শরীর এমন হয় তাহলে বাকিটা জীবন চলবে কি করে?
- বাকিটা জীবন না চললেও কিছু হবে না মামি। কারো দাসত্ব করার চাইতে মরে যাওয়া অনেক ভালো।
- বিয়েটা কি তোমার দাসত্ব মনে হয়? তাহলে কি আমাদের বিবাহিত সব নারীদের শুধু একটাই পরিচয়? আমরা দাসী?
- তা নয়তো কি? এই যে তোমার নাকে নাকফুল, হাতে চুড়ি এগুলো কি তোমার দাসত্বকে প্রমান করার জন্য যথেষ্ট নয়?
- মোটেও নয়। নাকের নাকফুল, হাতের বালা এগুলো আমাদের স্ত্রী জাতির সম্মানের বিষয়। এসব কখনোই দাসত্বের প্রতীক হতে পারে না।
- এটা তোমার অতি রঞ্জিত কল্পকথা ছোট মামি। তুমি নিজেও সেই দাসত্বের বেড়াজালে বন্দি হয়ে আছো। তাই তুমি নিজের বিষয়টাকে উপরে রেখেই কথা বলবে এটা আমি জানি।
- তোমার কেন মনে হচ্ছে, আমি তোমার মামার দাসী। তার স্ত্রী কেন মনে হচ্ছে না আমাকে?
- স্ত্রী শব্দটাই কেন জানি দাসি দাসি মনে হয়। তাছাড়া তুমি কি অস্বীকার করতে পারবে, তুমি সপ্তাহের যেই তিনদিন ঢাকায় যাও, মামা তোমার সাথে যায় না?
- হ্যা অবশ্যই যায়। কারন তোমার মামা আমাকে ভালোবাসে। সে জন্যই সে নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে সাপোর্ট দিতে তার সাথে যায়।
- তুমি মামার সাথে তাকে সাপোর্ট দিতে পিছু পিছু ছুটো না। তার মানে কি তুমি মামাকে ভালোবাসো না?
- অবশ্যই ভালোবাসি। কিন্তু সেই ভালোবাসা প্রমান করতে কি আমাকে তার পিছু পিছু ছুটতে হবে? ভালোবাসাতো আরো অনেকভাবে প্রকাশ করা যায়।
- তাহলে মামা তোমার পিছু পিছু যায় কেন? তার মানে মামা তোমাকে ভালোবাসার আড়ালে আরেকটা জিনিস করে। সেটা সন্দেহ। মামার ধারনা তোমার হয়তো অন্য কোন ছেলের সাথে সম্পর্ক আছে। এই জন্যই সে তোমার পিছু ছাড়ে না।
শিউলির এমন কথায় মীরার গা জ্বলতে লাগলো। ইচ্ছে করছিলো তার ফর্সা গাল দুটিকে চড়িয়ে লাল করে দিতে। মীরা তেমনটা করলো না। সে নিজেকে সংযত করে বললো, তুমি ভালো করেছো ঠিকই। কিন্তু নিজের মাঝে ভালো কোন শিক্ষা নিতে পারোনি।
- তোমার কি আমাকে অশিক্ষিত মনে হচ্ছে?
- না। মনে হচ্ছে তার চাইতেও বেশিকিছু। যে মেয়ে বিবাহের মত একটু পবিত্র আর বৈধ সম্পর্ককে স্বীকার করতে পারে না তাকে শিক্ষিত বলতে আমার বিবেকে বাধে। তোমাদের এখানে আসাটাই আমার ভুল হয়েছে। এই কয়দিনে তোমার এতটা অধঃপতন হয়েছে জানলে আমি কখনোই তোমাদের বাড়িতে তোমাকে বুঝাতে আসতাম না। তোমাকে আসতে কে বলেছে? চলে গেলেইতো পারো। নিজেও বাচো আমিও বাচি।
সালেহা বেগম স্বামীকে নিয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মেয়ের শেষ কথাখানি শোনার পর তিনি আর নিজেকে সংবরণ করতে পারলেন না। এক ছুটে গিয়ে শিউলির গালে সজোরে চড় বসিয়ে দিলেন।
মীরা পাশেই ছিলো। সালেহা বেগমলে আটকানোর কোনরকম চেষ্টা সে করলো না।
শিউলির কথায় মীরা যে খুব মৌনাহত হয়েছে সেটাভতার ভারী মুখ দেখেই স্পষ্ট অনুমান করা যায়। ধরা গলায় সে শুধু বললো, ওর জন্য আমাকে আর কখনো ডাকবেন না আপা। আমি যাই। বলেই মীরা দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো।
চড় খেয়ে শিউলির ফর্সা গাল দারুন লাল হয়ে গেছে। সে শিশুসুলভ স্বরে ভারী আর্তনাদ করে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা বাবার বুকে গিয়ে মুখ লুকিয়ে ফুপানো গলায় বলতে লাগলো - তুমিতো কখনো আমার কান্না সহ্য করতে পারতে না বাবা। আজ পারছো কিভাবে? আমার জন্য কি তোমক্র মন পুড়ে না? তোমার মায়া লাগে না আমার জন্য?
মোরশেদ সাহেব এক হাতে মেয়েকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরে অন্যহাতে চশমার ফাক দিয়ে চোখের পানি মুছলেন। মেয়ের জন্য তার মন গলে গেলো। চোখ বেয়ে পানি ঝড়ছে মেয়ের মমতায়।
এই মমতা সালেহা বেগমকে স্পর্শ করতে পারলো না। বরং তার ভেতরের রাগ আরো বহুগুনে বাড়তে লাগলো। বাপের বুকে মুখ লুকানো মেয়েকে এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে কর্কশ কন্ঠে বলতে শুরু করলেন- আমার যদি তোর বাপের সাথে বিয়ে না হইতো, তোরে যদি রাস্তাঘাটে জন্ম দিতাম তাইলে কার বুকে এমন কইরা মুখ লুকাইতি হারামজাদি!
মায়ের এমক্ন গুরত্বপূর্ণ কথাখানি শিউলি কানে তুললো বলে মনে হলো না। সে পুনরায় বাপের প্রশস্থ বুক জমিনে নিজের গুনেধরা মাথাখানি গুজে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলো।
মোরশেদ সাহেব হাতের ইশারায় স্ত্রীকে বুঝিয়ে দিলেন, যথেষ্ট হয়েছে। আজ থাক।
সালেহা বেগম রাগে ফুসতে ফুসতে মুখখানিতে নীলাভ বর্ণ ধারন করেছেন।
স্বামীর বাধায় এ যাত্রায় মেয়ের প্রতি নিজের এই রাগটার একবিন্দুও আর ঝড়াতে পারলেন না৷
শিউলি বাবার বুকে মাথা রেখে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো, বাবা তুমি আমাকে এখান থেকে মুক্ত করে দাও। আমি শহরে চলে যাবো। আমি আমার জীবন নিয়ে বাচতে চাই বাবা। আমার মত করে আমাকে বাচতে দাও।
মোরশেদ সাহেব মেয়েকে আর আটকালেন না। বুকে পাথর বেধে মনকে লোহার মত শক্ত করে পরদিন মেয়েকে শহরে পাঠিয়ে দিলেন। সালেহা বেগমের শত ক্রোধ, সহস্র মমতা আর এত এত চোখের পানি এসবের কোনকিছুই নিজের মেয়ের সাথে পেরে ওঠলো না।
ঢাকাতে শিউলির আশ্রয় বলতে শুধু একটাই ঠিকানা। সেটা নীলার বাসা৷ মিরপুরের এই বাসার সামনে সে দুপুর তিনটা থেকে দাঁড়িয়ে আছে। নীলা বাড়িতে নেই৷ কোথায় গেছে, কখন ফিরবে দারোয়ান বেটা কিছুই বলতে পারলো না।
নীরব একটা গলিতে কাধে একখানি ভারী ব্যাগ ঝুলিয়ে দুঃখী মুখ করে শিউলি দাঁড়িয়ে আছে। নীলাকে ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না। রাগে তার সারা শরীর কাপতে লাগলো।
শিউলি বুঝতে পারলো সে রেগে আছে শুধু এই কারনেই তার শরীরটা কাপছে না। এই কাপুনির অন্য আরেকটা কারন আছে। সেটা পেটের ক্ষুধা৷ সকাল থেকে পেটের ভেতর দানা পানি কিছুই পড়েনি৷ এমন অবস্থায় সরু একটা নীরব গলির মুখে একা একা দাঁড়িয়ে থাকতে ভয় লাগছে শিউলির৷ এই ভয়ের কারন সে জানে না। এই মূহর্তে কেন জানি নিজেকে শুধু আশ্রয়হীন মনে হতো লাগলো তার।
নীলা যখন ফিরলো তখন প্রায় সন্ধ্যা। শিউলিকে দেখেই সে বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করলো, কিরে তুই! কখন আসলি? অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে আছিস বুঝি?
সে আর অনেক্ষণ হলো কই? দুপুর তিনটায় এসে দাড়িয়েছি, এখন বাজে ছয়টা৷ মাত্র তিন ঘন্টা। এই তিন ঘন্টা নিশ্চয়ই অনেক লম্বা সময় নয়?
নীলা লাজুক ভঙ্গিতে জীভ কেটে বললো, তোকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেললামরে!
কষ্ট দেওয়ার পরে সেটা বলে আর লাভ কি? এখন কি বাড়ির ভেতরে নিবি নাকি এখান থেকেই বিদায় করে দিবি?
বিদায় করে দিলেই বা যাবি কোথায়? আমি ছাড়া এই শহরে তোর আর আছেটা কে শুনি!
সত্যি-ইতো, এই শহরে নীলাই যে তার একমাত্র আশ্রয়। শুধুমাত্র এই শহর কেনো, পুরো দুনিয়াতে একমাত্র নীলার আশ্রয় ছাড়া শিউলির অন্য আর ঠিকানা কই? পিতা মাতার আশ্রয় সে একেবারে ত্যাগ করে বেড়িয়ে এসেছে। প্রতিজ্ঞা করেছে আর কখনোই ফিরবে না সেখানে। শিউলির এমন সিদ্বান্তে তার বাবা- মার অন্তর ভেঙে গেছে। হৃদয়ের সবটুকু ব্যাথায় নীল হয়ে গেছে
এই ব্যাথার কারন, তারা নিজেদের মেয়েকে একটি ঠিকানা খুজে দিতে চেয়েছিলেন। যেই ঠিকানায় একটা মেয়ের সত্যিকারের আশ্রয়, সত্যিকারের সুখ নিহীত থাকে।
কাপড়ের ব্যাগটা নিয়ে নীলা যাচ্ছে আগে আগে৷ শিউলি তার পিছে।
বুঝলি শিউলি, গত সপ্তাহে আমাদের বিল্ডিংয়ে একটা ভয়ানক ব্যাপার ঘটে গেছে। একেবারে হুলস্থুল কান্ড।
কি সেই হুলস্থুল কান্ড?
আমার পাশের ফ্লাটের মেয়েটার বিয়ে হলো ছয় মাস আগে। এখন সে স্বামীর ঘর করবে না। কিন্তু মেয়েটার স্বামী তাকে ছাড়বে না। এই নিয়ে প্রায়-ই ঐ লোকটা এখানে এসে মেয়েটাকে বিরক্ত করে। গত সপ্তাহে এরকমই এক বাক বিতন্ডার এক পর্যায়ে সে নিজের শ্বাশুড়ির মাথা ফাটিয়ে দিলো।
তারপর কি হলো?
যা হওয়ার তাই হলো। পুলিশ এসে ছেলেটাকে ধরে নিয়ে গেলো আর বলা হলো, অপরিচিত কাউকে যেন ভিতরে ঢুকতে দেওয়া না হয়।
এই কারনেই বুঝি তোদের দারোয়ান আমাকে তিন ঘন্টা দাড় করিয়ে রাখলো।
লোকটার কোন দোষ নাইরে। বেচারা এখানে নতুন এসেছে। সমস্যা নেই, তোকে এখন ওর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো। পরের বার সে তোকে আর বাইরে দাড় করিয়ে রাখবে না।
ঘরের ভেতরে ঢুকে শিউলির দূর্বল দেহখানি মেঝেতে লুটিয়ে পড়বার মত অবস্থা হলো। বহু কষ্টে সে নিজেকে সামলে নীলাকে ডেকে বললো, আমি বাথরুমে ঢুকলাম। লম্বা একটা গোছল দেবো। এই ফাকে তুই কিছু খাবার জোগাড় কর। পেটে ক্ষুধার বাঘ দৌড়াচ্ছে।
নীলার সাথে শিউলীর বন্ধুত্বটা বেশ পুরানো৷ সেই বাল্যকাল থেকে শুরু। এখন ওদের ভরা যৌবন। লম্বা এই সময়টুকুতে নিজেদের সম্পর্কের মাঝে বিন্দু পরিমান ফাটল ধরেনি। বরং সময়ের ব্যবধানে সেই সম্পর্ক এখন আরো পাকা পুক্ত হয়েছে।
শিউলি আধঘন্টারও বেশি সময় পর বাথরুম থেকে বেরুলো। এখন নিজেকে অনেক হালকা মনে হচ্ছে। কিন্তু পেটের ক্ষিধেটা বেড়েছে বহুগুনে৷ এই ক্ষিধেটাকে বিদায় দিতে হবে।
খাবার টেবিলের কাছে আসতেই লম্বা, ফর্সা একজন যুবক তার দিকে হাত বাড়িয়ে বললো – হায়।
শিউলি অপ্রস্তুত গলায় বললো, আপনি কে? আপনি এখানে কি করে এলেন?
- আমি নীলার বন্ধু।
- আপনি তার কেমন বন্ধু? অনুমতি ছাড়া এই ঘরে ঢুকেছেন কেন?
এবারে লোকটা অল্প হাসলো। বললো, এই ঘরে ঢোকার অনুমতি আমার আছে। বাই দ্যা ওয়ে আমার নাম আসিফ।
শিউলি স্বাভাবিক হলো। বিস্ময়ভরা গলায় বললো, আপনি-ই আসিফ! নীলার মুখে আপনার কথা অনেকবার শুনেছি।
- কি শুনেছেন?
- নীলা বলেছিলো আপনি খুব সুন্দর।
- তাই নাকি?
- শুধু কি তাই? আপনি এর চাইতেও আরো বেশি সুন্দর। নীলা সত্যি-ই খুব লাকি যে আপনার মত এমন সুদর্শন একজন পুরুষকে নিজের পার্টনার হিসেবে পেয়েছে।
এতক্ষণে নীলা খাবার নিয়ে টেবিলে উপস্থিত হলো। মুখ হাসি হাসি করে বললো, কিরে শিউলি আমি খুব লাকি এই ভেবে তোর আবার হিংসে হচ্ছে নাকি?
কিছুটা উদাস গলায় শিউলি বললো, হিংসে করলেই লাভ কি হবে বল? তোর সুন্দর পুরুষটাতো আর আমার হয়ে যাবে না।
খাবার টেবিলে অনেক্ষন গল্প হলো। গল্পের ফাকে ফাকে শিউলি আর চোখে আসিফের দিকে তাকাচ্ছিলো। অচেনা অজানা এই লোকটাকে ক্ষনিকেই তার অতি কাছের কোন আপনজন মনে হচ্ছিলো।
আজ অনেক রাত পর্যন্ত শিউলি জেগে রইলো। সন্ধ্যার পর থেকে তার ভিতরে যেই অদ্ভুত এক ছটফটানি শুরু হয়েছিলো সেটা এখনো থামছে না। না থামার কারনটা সে ধরতে পারছে না। এমনটা তো সিনেমা বা নাটকে হয়। নায়ক-নায়িকা একে অন্যকে দেখার পরে দুজনার ভেতরে অদ্ভুত সব কাপুনি ঝাকুনি তৈরি হয়।রাতে চুপিচুপি নায়ক চলে যায় তার নায়িকার ঘরে। ঘুমহীন চোখ মেলে নায়িকা চেয়ে থাকে তার প্রিয় পুরুষটির দিকে।
শিউলির মনে প্রশ্ন জাগলো তার ভেতরের এই ছটফটানির মানে কি তবে এই, সোহেল আজ রাতে তার ঘরে আসবে। দুজন মিলে গল্প আর ভালোবাসায় সারাটা রাত কাটিয়ে দিবে!
রাতে সত্যি সত্যি সোহেল আসলো। যখন এলো তখন প্রায় মধ্যরাত। এমন অসময়ে তাকে দেখে শিউলি ভরকে গেলো। আতংকিত গলায় বললো, এতো রাতে আপনি এখানে?
- কেন, তোমার ঘরে আসা কি বারণ আছে?
শিউলি এই কথার জবাব না দিয়ে বললো- এমন অসময়ে আসলেন, কেউ দেখলেতো খারাপ ভাবতে পারে।
- যে যেটা ভাবতে চায় তাকে সেটা ভাবতে দাও না! অন্যেরা কি ভাবলো আর কি ভাবলো না সেটা নিয়েতো ভয় পায় ভীতুরা। কিন্তু তুমিতো ভীতু নও।
- আপনার কি আমাকে সাহসী মনে হয়?
- অবশ্যই তুমি সাহসী একজন মেয়ে। এই মুহূর্তে আমার সামনে ওড়নাবিহীন খোলা বুকে তোমার বসে থাকাটাই সেই সাহসিকতার প্রমাণ দেয়।
সম্পর্কবিহীন একজন পুরুষের মুখ থেকে এমন কথা শুনলে মেয়েরা অন্তত একটুখানি সাধারণ লজ্জা প্রকাশ করে। বুকের উপর ওড়নার ভাজটা ঠিক করে নেয়। কেউ কেউ মাথার ঘোমটাখানিতেও একটাবার হাত বুলিয়ে নেয়।
কিন্তু শিউলি এসব কোনকিছুর-ই ধার ধারলো না। সে নিজের সাহসিকতা প্রমাণ করতে ব্যস্ত হলো।
এখনকার সমাজে কিছু মানুষ এমন শ্রেণির আছে যারা শরীরের নগ্নতা আর অশ্লীলতাকে নিজেদের সাহসীকতা মনে করে। শিউলিও সেই শ্রেণির -ই একজন।
সোহেলের সাথে সাক্ষাৎের প্রথম রাতে শিউলি নিজের সাহসীকতার প্রমান দিতে না পারলেও তৃতীয় রাতে সে ঠিকই নিজেকে সাহসী কন্যা প্রমাণ করলো।
একজন সম্পর্কবিহীন পুরুষকে নিজের সম্ভ্রমের সবটুকু বিলিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না। উল্টো মুখে সুখের হাসি হেসে বললো, আমার শরীর - আমার সিদ্বান্ত।
শিউলির এমন স্বাধীনতা মোটেও সহ্য হলো না সীমার।
এক সোমবারে ভয়ানক মাথাব্যাথা নিয়ে সীমা বাড়ি ফিরে দেখলো সোহেল নিজের ঘরে নেই। অথচ এই সময়টাতে ঘরে বসে তার ফ্রিল্যান্সিং এর কাজ করার কথা।
সীমা লক্ষ্য করলো শিউলির ঘর থেকে ফিস ফিস আওয়াজ ভেসে আসছে। সে ছুটে গেলো সেদিকে। প্রিয় মানুষটিকে অন্য একটি মেয়ের সাথে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে সীমার মরে যেতে ইচ্ছে হলো। ছোটবেলায় সে যখন খুব কষ্ট পেতো তখন খুব চিৎকার, কান্নাকাটি করতো। বয়স হওয়ার সাথে সাথে সেই অভ্যাস চলে গেছে। কিন্তু আজ এই মূহর্তে আরেকবার তার হাউমাউ করে কাদতে ইচ্ছে করছে। বহুকষ্টে সীমা নিজেকে সামলে ফেললো। শান্ত ভঙ্গিতে ঘরের ভেতর ঢুকে কঠিন হাতে শিউলির চুলের মুঠিতে ধরে অন্য হাতে তার গালে কষে দুটি চড় মারলো।
চড় খাওয়া গালে হাত বুলাতে বুলাতে শিউলি বার কয়েক সোহেলের দিকে তাকালো। সোহেল এতে কোন প্রকার কর্ণপাত করলো না। উল্টো নিজের চোখেমুখে অপরাধী ভাব ফুটিয়ে ক্ষমা পাওয়ার আশায় সীমার হাত চেপে ধরে বসে রইলো। নিজের প্রিয় পুরুষকে ক্ষমা করার ব্যাপারে সীমা কোন আগ্রহ দেখালো না। তার দৃষ্টি শুধু শিউলির মাঝেই সীমাবদ্ব। আগুন ঝড়া গলায় সীমা বললো, কাল নাগিনী তোকে এইজন্যই কি আমার বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলাম? বেইমান মাগি তোরতো মরে যাওয়া উচিত। তুই আমার বাড়ি থেকে এই মূহর্তে চলে যাবি। নয়তো তোকে আমি পুলিশে ধরিয়ে দিবো।
শিউলি দরাজ গলায় বললো- তুই আমাকে পুলিশে ধরিয়ে দিবি, আমার অপরাধ কি?
সীমা এই অপরাধের প্রমাণ যোগাতে ব্যার্থ হলো। সে এমন দেশে বাস করে যেই দেশের আইন দুজন সম্পর্ক বিহীন যুবক যুবতীকে আপত্তিকর অবস্থায় হাতে নাতে ধরলেও সর্বোচ্চ ১০০ টাকা জরিমানা করা ছাড়া অন্য কোন শাস্তি নেই। এই যে সীমা এখন সোহেলের সাথে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে আছে, স্বামী-স্ত্রী না হওয়া সত্বেও একসাথে বাস করছে এটাও এখানে কোন অপরাধ নয়।
- কিরে সীমা চুপ করে আছিস কেন?
আমাকে কি জন্যে থাপ্পড় মারলি উত্তর দে।
- তুই অপরাধ করেছিস, এই জন্য চড় মেড়েছি।
- তোর বয়ফ্রেন্ডের সাথে শুয়েছি, এটা কি আমার অপরাধ?
- কেন তোর কাছে কি এটা মহৎ কাজ মনে হচ্ছে? নির্লজ্জ, বেহায়া কোথাকার!
শিউলি এবার সোহেলের দিকে তাকালো। চেচানো গলায় বললো, তোমার সামনে সীমা আমাকে অপমান করছে তুমি কিছু বলছো না কেন সোহেল?
সোহেল কিছু জবাব দিলো না। সীমার দিকে চেয়ে জোড়া হাতে বিনীত গলায় বললো, আমার খুব বড় ভুল হয়ে গেছে সীমা। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও।
সীমা চোখের পানি মুছলো। গোঙানির সুরে বললো, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। এই বলে একটু থেমে সে আবার বললো, আর তুমি চাইলে আমাকে ছেড়ে শিউলির সাথেও থাকতে পারো। আমি বাধা দেবো না।
- তুমি কি পাগল হয়েছো নাকি সীমা? আমার মাথাটা কি এতটাই খারাপ হয়ে গেছে যে আমি তোমাকে ছেড়ে ওর মত আশ্রয়হীন একটা মেয়ের সাথে থাকবো? এমনটা তুমি কি করে ভাবতে পারলে?
শিউলি নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় পলকহীন দৃষ্টিতে ক্ষনকতক চেয়ে রইলো সোহেলের দিকে। হয়তো তার বিশ্বাস আর মন দুটোই ভেঙে গেছে। তার চোখ থেকে গাল বেয়ে টপ টপ করে কয়েকফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো।
সীমা বললো, শুনলি মাগি আমার বয়ফ্রেন্ড কি বললো? সে আমাকে ছেড়ে তোর সাথে কখনোই যাবে না। আমিতো সোহেলকে ক্ষমা করে দুজনে আবার এক হয়ে গেলাম। তুই এখন কি করবি?
শিউলি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। তার ঠোট দুটি কাপছে। প্রচন্ড অপমানের সময় কারো কারো ঠোট কাপে। শিউলি হয়তো ওদের-ই একজন।
আমরা দুজন এখন বাইরে যাবো। ফিরে এসে তোকে যদি আর না দেখি তাহলে অনেক বেশি খুশি হবো। সবচেয়ে বেশি খুশি হবো যদি এসে দেখি তুই মরে গেছিস।
সীমা ঘর থেকে বেড়িয়ে সোহেলকে নিয়ে সোজা চলে গেলো রমনা পার্কে। সেখানে একটা সুবিশাল উচু গাছের নিচে বসেছে দুজনে। সোহেল ক্রমাগত কান ধরে উঠবস করছে তার সামনে। পাব্লিক প্লেসে বছর ত্রিশের একজন যুবক কান ধরে উঠবস করছে। আশপাশের অনেকেই এমন দৃশ্য কৌতুহলের দৃষ্টিতে চেয়ে দেখছে। কেউ কেউ হয়তো এতে বেশ মজা পাচ্ছে। এসব কিছুর শুধুমাত্র একটাই উদ্দেশ্য। সেটা হলো সীমার রাগ ভাঙানো।
সন্ধ্যার মধ্যে সীমার রাগ পুরোপুরি থেমে গেলো। আজ দুজনে মিলে ভালো একটা রেস্টুরেন্টে খাওয়া শেষ করলো।
যখন বাড়ি ফিরলো ততক্ষণে ঘটে গেছে অনেক কিছু। শিউলি বাডি ছেড়ে চলে গেছে। যাওয়ার আগে টেবিলে একটা চিঠি লিখে গেছে।
প্রিয় সীমা,
বেচে থাকাটা আমার কাছে এখন পুরোপুরি অর্থহীন। এমন নিরর্থক জীবন নিয়ে বেচে থাকার কোন মানে হয় না।
জানি আমাকে ক্ষমা করাটা তোর কাছে খুবই কঠিন বিষয়ের একটি। কিন্তু তারপরেও বলবো, যদি কখনো সম্ভব হয় তাহলে আমাকে ক্ষমা করে দিস।
বিনীতা
শিউলি
সীমা কাগজখানি জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলো। সোহেল একবার জানতে চাইলো, তুমি জানালা দিয়ে বাইরে কি ফেললে?
- এত কিছু তোমার দেখার প্রয়োজন আছে নাকি? চুপচাপ গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।
সোহেল একান্ত বাধ্যগত হয়ে ঘুমাতে চলে গেলো। সীমা জেগে রইলো। আজ রাতে তার আর ঘুম হবে না। মন খারাপের রাত গুলো তার পুরোপুরি নির্ঘুম কাটে। এমন নির্ঘুম রাত কাটাতে সীমার তেমন কোন কষ্ট হয় না। হয়তো এটা তার অভ্যাস হয়ে গেছে। অভ্যাসের জিনিসগুলো মানুষ খুব মন দিয়ে করতে পারে।
সত্যমনা লেখক -
Monir Hossain.
COMMENTS