'বিশ্বাস' এর সংজ্ঞা কী। 'বিশ্বাস' বলেই কি তা প্রত্যাখ্যাত ? 'বিশ্বাস' এর সাথে কি যুক্তির সংশ্লিষ্টতা নাই ? নাস্তিকরা বিশ্বাসকে যুক্তি দিয়ে বিচার করা থেকে কেন পালিয়ে থাকেন ?
'বিশ্বাস' এর অনেকগুলো সংজ্ঞা রয়েছে। এবং প্রতিটি সংজ্ঞাই নিজের জায়গা থেকে সঠিক। যদিও কোনো একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞার ওপর সবাই ঐক্যমত পোষণ করেননি। কিন্তু সবগুলো সংজ্ঞার ভেতরে অবশ্যই সঠিক সংজ্ঞাটি রয়েছে। সবাই যেহেতু নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞার ওপর ঐক্যমত হননি তাই 'বিশ্বাস' এর কোনো সংজ্ঞাই নাই বলাটা যেমন মুর্খতা। তদ্রূপ প্রতিটি সংজ্ঞাই নিজের জায়গা থেকে সঠিক, তাই একটা নির্দিষ্ট সংজ্ঞার রেফারেন্স কোট করে বাকিগুলোকে ভুল বলাটাও মুর্খতা। যেমন ধরুন, আপনার হাতে একটা টক ফল আছে। এই ফলটাকে কেউ বলছে, লেবু। কেউ বলছে, মালটা। কেউ বলছে, জাম্বুরা। কেউ বলছে জলপাই। আবার কেউ বলছে তেঁতুল। সারা পৃথিবীর সব মানুষ এর বাইরে আর কিছু বলছে না। তাহলে আপনি নির্দ্ধিধায় বলতে পারেন, আপনার হাতের ফলটি অবশ্যই উপরে উল্লেখিত কোনো একটা ক্যাটাগরির হবে।
আমরা 'বিশ্বাস' এর কয়েকটি সংজ্ঞা নিয়ে আলোচনা করব। তার আগে বিশ্বাসের সংজ্ঞা নিয়ে নাস্তিকদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য আলোচনা করা যাক। বঙ্গীয় নাস্তিকদের অন্যতম একটি ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে _
"আমার মতে, বিশ্বাস যার অপর নাম ভরসা। যে জায়গায় বা যে মানুষের ওপর ভরসা করতে পারবেন ওখানে আপনি বিশ্বাস এর অস্তিত্ব অনুভব করতে পারবেন।"
খুবই নিম্ন মানের একটি সংজ্ঞা এটা। যেমন ধরুন, চোর, ছিনতাইকারী বা ডাকাতকে ভরসা করে আপনার ব্যাগভর্তি টাকা তার হাতে তুলে দিবেন না। এবং ভরসা থেকে বিশ্বাসের অস্তিত্বও খুঁজতে যাবেন না। বরং উল্টোটা করবেন। যদি তার ওপর বিশ্বাস জন্মে। তাহলে সেই বিশ্বাসের পর ভরসা করবেন।
আবার তারাই বলছেন _
"বিশ্বাস কখনো যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করা যায় না।"
এদিকে নাস্তিকদের মনীষী বলে খ্যাত একজন। তিনি বলছেন _
"জ্ঞানের সহিত বিশ্বাসের ঘনিষ্ঠতম সম্পর্ক। বরং বলা হইয়া থাকে যে,জ্ঞান মাত্রই বিশ্বাস।"(সত্যের সন্ধান পৃ ৭)
এবার উইকিপিডিয়া থেকে 'বিশ্বাস' এর কিছু উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা জেনেনিই __
"বিশ্বাস বলতে সাধারণত পারিপার্শ্বিক বিষয়-বস্তুরাজি ও জগৎ সম্পর্কে কোনো সত্তার স্থায়ী-অস্থায়ী প্রত্যক্ষণকৃত ধারণাগত উপলব্ধি বা জ্ঞান এবং তার নিশ্চয়তার উপর আস্থা বোঝানো হয় । সমাজবিজ্ঞান , মনোবিজ্ঞান , জ্ঞানতত্ত্ব ইত্যাদি বিভিন্ন আঙ্গিকে বিশ্বাস শব্দটি বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে খানিকটা আলাদা অর্থ বহন করতে পারে , তাই জ্ঞান , সত্য ইত্যাদির মত বিশ্বাসেরও কোনো একটি সর্বজনসম্মত সংজ্ঞা নেই বলে অনেকের ধারণা ।
কোনো বিষয় সত্য না মিথ্যা তা বিচার করে - সত্য মনে হলে তা "বিশ্বাস করা" অথবা মিথ্যা মনে হলে অবিশ্বাস করা আর মিথ্যা হবার সম্ভাবনা বেশি মনে হলে সন্দেহ করা হয় । বিশ্বাস মানে হতে পারে আস্থা (faith) , ভরসা (trust) । বিশ্বাসের দৃঢ়তা (বিশ্বাস যত বেশি সন্দেহ তত কম) খুব বেশি হলে তাকে বলা যায় ভক্তি বা অন্ধবিশ্বাস । আবার বিশ্বাস মানে হতে পারে আশা (hope) বা আশ্বাস (assurance) বা বিশ্বাস করার ইচ্ছা (willingness to trust) ।
বিশ্বাস হতে পারে কোন বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ অনুভূতির সচেতন অনুধাবন; বা কোনো তথ্য (information) বোধগম্য হওয়া এবং বিভিন্ন পরিস্থিতিতে যাচাই করার পর এই বোধের নিশ্চয়তা সম্বন্ধে প্রত্যয় বা প্রতীতি জন্মালে (সত্য বলে স্থায়ী ধারণা) হলে তাকে জ্ঞান (knowledge) বলা যায়। পর্যবেক্ষণের উপর যুক্তির (ও পূর্বলব্ধ জ্ঞানের) সাহায্যে বিচার (judge) করে কোন বিষয় সত্য বলে সিদ্ধান্ত নিলে তা থেকে নতুন জ্ঞান জন্মায়। এইভাবে মনের মধ্যে উপলব্ধ সত্যগুলিকে জুড়ে যে তত্ত্বের জাল বোনা হতে থাকে তাদের বিষয়বস্তুগুলি সামগ্রিকভাবে হল জ্ঞান আর তাদের গ্রহণযোগ্যতার সচেতন অনুমোদন হল বিশ্বাস। জ্ঞানের বিশেষত্ব হলো শুধু পূর্বের অভিজ্ঞতাই নয় ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি ও অজ্ঞাত পরিস্থিতি সম্বন্ধেও এর দ্বারা (induction) ভবিষ্যৎবাণী করা সম্ভব ও সেই ভবিষ্যৎবাণীর সাফল্য বিশ্বাসকে বজায় রাখে। জ্ঞানের গভীরতা, ব্যপ্তি ও বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তাকে প্রয়োগ করে ভালো ফল লাভের সম্ভাবনার উপর নির্ভর করে জ্ঞান ক্ষেত্রবিশেষে বিচক্ষণতা, প্রজ্ঞা(wisdom) বা দূরদৃষ্টি (insight) ইত্যাদি হিসাবে পরিগণিত হতে পারে।
বিশ্বাস হতে পারে একজনের ব্যক্তিগত কষ্ট কল্পনা। যেমন সিজোফ্রেনিয়ার রোগীরা অনেক কিছু দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করে থাকে এবং তার বিরুদ্ধে প্রমাণ দেখালে সেই বিশ্বাস আরো বদ্ধমূল হয়ে যেতে থাকে। এই ধরনের ভিত্তিহীন বা যুক্তির অতীত বদ্ধমূল অন্ধবিশ্বাসকে বলে ডিলিউসন (delusion)। আবার বিশ্বাস হতে পারে কোন জনতার সম্মিলিত জনমত। যেমন নানা ধরনের ধর্মবিশ্বাস।
বিশ্বাসের সঙ্গে মূল্যবোধ ও ভালোমন্দ বিচারও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। কোন কিছুকে ভালো বলে বিশ্বাস না হলে তাকে খারাপ বলেই সন্দেহ হবে। সন্দেহ (বিশ্বাস করার অনিচ্ছা) খুব জোরালো হলে এবং অন্যান্য চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে দিলে তাকে বলে প্যারানইয়া, যার বিশেষণ হল প্যারানয়েড। সিজোফ্রেনিয়ার চারটি প্রধান ধরনের মধ্যে প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়া একটি।"
উইকিপিডিয়ার 'বিশ্বাস' এর সংজ্ঞাগুলো পড়ে হয়তো কিছুটা হলেও 'বিশ্বাস' এর সংজ্ঞা আপনি বুঝতে পেরেছেন।
স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস। একটি যৌক্তিক বিশ্লেষণ।
‘অনুমান’ হলো দর্শনের একটি পরিভাষা।যেমনি ভাবে ‘প্রত্যক্ষ’ দর্শনের একটি পরিভাষা।প্রত্যক্ষের মাধ্যমে যে বিশ্বাস বা জ্ঞান অর্জিত হয়, তাকে মেনে নেয়া যেমন আবশ্যক।তেমনি ভাবে অনুমানের মাধ্যমে যে বিশ্বাস বা জ্ঞান অর্জিত হয়, তাকে মেনে নেয়াও আবশ্যক।
‘অনুমান’ কী।‘অনুমান’ এর ওপর বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত হয় কিভাবে। অনুমানের ওপর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাসকে কেন মেনে নিতেই হয়। এই বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে ‘অনুমান’ এর ছোট্ট একটি উদাহরণ দেখে নিই- মানুষের ‘প্রাণ শক্তি’। যার সাহায্যে মানুষ চলা ফেরা করতে পারে।অফিস আদালত করতে পারে।সংসার সামলাতে পারে।
কিন্তু আমরা কি মানুষের ‘প্রাণ শক্তি’ দেখতে পারি?না, পারি না। কিন্তু আমরা তা বিশ্বাস করি।কারণ মানুষের এত এত কার্যকালাপই প্রমাণ করে তার ভেতর ‘প্রাণ শক্তি’ আছে।
এবার আসুন জেনেনিই ‘অনুমান’ কাকে বলে? অনুমান হলো, “যৌক্তিক বাক্যের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ সম্পর্কের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহনের পদ্ধতি”।
‘অনুমান’ এর ওপর বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত হয় কিভাবে? অনুমান এর ওপর বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত হয় দু'ভাবে।
১/ অমাধ্যম অনুমান। অর্থাৎ এমন অনুমান, যার যৌক্তিক বাক্য থেকে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে অন্য কোনো বাক্যের উপস্থিতি প্রয়োজন পড়ে না। যেমন:
-সকল দার্শনিক হন চিন্তাশীল ব্যক্তি।
-সুতরাং কোনো কোনো চিন্তাশীল ব্যক্তি হন দার্শনিক।
২/ মাধ্যম অনুমান। অর্থাৎ যার যৌক্তিক বাক্য থেকে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে এক বা একাধিক বাক্যের প্রয়োজন হয়। যেমন:
-সকল মানুষ হয় মরনশীল।
- আইন্সটাইন মানুষ।
- সুতরাং আইন্সটাইন হন মরনশীল।
সুতরাং 'অনুমান', মাধ্যম হোক আর অমাধ্যম হোক। সেটা যৌক্তিক বাক্য থেকে সিদ্ধান্তে অনিবার্যভাবে নিঃসৃত হয়।
এবার আসুন একটি যৌক্তিক বাক্য বিশ্লেষণ করে আসি। "মাহাবিশ্বে যা কিছু আছে সবই সৃষ্ট"। আর সৃষ্টি অস্তিত্বে আসতে পারে না স্রষ্টা ছাড়া। সুতরাং মাহাবিশ্বের স্রষ্টা থাকা আবশ্যক।
আর এই পদ্ধতিকে এরিস্টটলীয় যুক্তিবিদ্যার সিলোজিজম বলা হয়। অর্থাৎ দু'টি যৌক্তিক বাক্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাকে প্রধান বলে মনে করা।
দর্শন কখনো স্রষ্টাকে অস্বীকার করেনি। কারণ, আজকে যে বিজ্ঞান আমরা দেখছি, সেই বিজ্ঞানের জন্ম দর্শন থেকে। আর দর্শন নিজেই এসেছে ধর্ম থেকে। তাই মূল দর্শন স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তাগিদ দিয়েছে। এমন কি দর্শনের যতো শাখা আছে যেমন:
জ্ঞানতত্ত্ব।
অভিজ্ঞতাবাদ।
মূল্যবিদ্যা।
যুক্তিবিদ্যা।
অধিবিদ্যা।
রাজনৈতিক দর্শন।
সেগুলোও স্রষ্টাকে অস্বীকার করেনি।একই ভাবে দার্শনিক যত মতবাদ আছে
যেমন:
বাস্তববাদ ও নামবাদ।
বুদ্ধিবাদ।
অভিজ্ঞতাবাদ।
বিচারবাদ।
স্বজ্ঞাবাদ।
ভাববাদ।
প্রয়োগবাদ।
রুপতত্ত্ব।
অস্তিত্ববাদ।
এগুলোর অধিকাংশই স্রষ্টার অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিয়েছে।
বিশ্বাসকে যুক্তি দিয়ে বিচার করা থেকে নাস্তিকরা পালিয়ে থাকার অন্যতম কারণ হলো, স্রষ্টা বিশ্বাসের পিছনে অসংখ্য যুক্তি বা লজিক আছে। যেগুলো নাস্তিকদের পক্ষে খণ্ডন করা কখনোই সম্ভব নয়। আর স্রষ্টার প্রতি তাদের অবিশ্বাস। এবং এই অবিশ্বাসটাও শুধু মাত্র হঠকারিতাবসত।
সত্যমনা লেখক
আহমাদ আব্দুর রাজ্জাক
সত্যমনা ডট কম
COMMENTS