কিন্তু সীমা তেমন কিছুই করেনি। কখনো আমার সংসার থেকে চলে যাওয়ার কথা বলেনি। আকার ইঙ্গিতেও বলবার চেষ্ঠা করেনি। অথচ তার পারিবারিক হিস্টোরি বলে- এমনটা তার করা উচিত ছিলো। যেখানে ওদের চারজন ভাই বোনের তিনজন বাবা, সেখানে সীমার দুইটি সন্তানের শুধুমাত্র একজন বাবা। সেই বাবা আমি। সীমার দুই বাচ্চার বাবা হতে পেরে আমি যতটা না আনন্দিত, তার চেয়ে অনেক বেশি খুশি এবং পুলকিত ওর মত একটি মেয়ের স্বামী হতে পেরে।
সীমা আমার অবস্থান জানে৷ আমার অর্থকড়ির সীমানাটাও তার অজানা নয়। সে কখনোই সেই সীমানা অতিক্রম করে আমার কাছে অসাধ্য কিছু চেয়ে বসে না। আমি যেন শুধু তার স্বামী-ই নই, তার সবচেয়ে বড় অভিভাবক। যাকে দু চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়৷ ভালোবাসা যায়। সীমা নিজের 'মন ভালো সময়টাতে' আমার বুকে মাথা রেখে প্রাণ খুলে হাসে৷ তখন মনে হয় সে-ই হয়তোও দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষ।
এক সন্ধ্যায় আমি বাড়ি ফিরে দেখি সীমার বড় বোন পারু এসেছে। পারু খুবই সিরিয়াস ভঙ্গিতে ইনিয়ে বিনিয়ে সীমাকে কিছু বুঝাতে চাইছে৷ সীমা স্বাভাবিক ভাবে পারুর কথার সাথে সাথে নিজের মাথাখানি দুলাচ্ছে।
এই পারু মেয়েটাকে আমার একদম-ই সহ্য হয় না৷ আমি একেবারেই চাই না সে কখনো আমাদের বাড়িতে আসুক। এই না চাওয়ার অনেকগুলো কারন আছে৷
মাস কয়েক আগে পারুর লেখা একটি বই বেড়িয়েছে৷ বইয়ের নাম, পুরুষ তুমি মানুষ হও আগে। সেই বইয়ের একটা কপি সে সীমাকেও দিয়েছিলো৷ সীমা সেই বইটা রাখেনি৷ এই না রাখার কারনে পারু সেদিন তাকে অনেক কথা শুনিয়েছিলো। তোরা সারাজীবন পুরুষের দাসী হয়েই থাকবি। জেনে রাখিস এই পুরুষ নামের অমানুষগুলো কখনোই মানুষ হবে না। এরা সমাজের কীট৷ যারা একটি নারী বলতে সেই নারীর শরীর ছাড়া আর কিচ্ছু বুঝে না৷ আমাদের উচিৎ এই কীটগুলোকে পায়ে পিষে মেরে ফেলা। এই কাজটা তখনই সম্ভব হবে যখন আমরা সবাই এক হতে পারবো৷ বুঝলি সীমা, বুঝলি।
সেদিন সীমা হয়তো কিছুই বুঝেনি। তবে পারু মাঝে মাঝে আমাদের এখানে এসে তাকে এসব বুঝাবার চেষ্ঠা করে।
আজও হয়তো তেমন কিছুই করছে৷ পারুর হাতের নাচন বাচন দেখে এমনটাই মনে হচ্ছে।
সেদিন খুব কড়াভাবে কঠিন গলায় পারুকে বলেছিলাম, তুমি আর কখনোই আমাদের এখানে আসবে না। আমার এমন বাক আঘাতে পারুর চোখ দুটি লাল হয়ে উঠেছিলো। সে কিছু না বলে চলে গেলো।
সেই যে গেলো আর এলো না। মাঝখামে কেটে গেলো পনেরোটি বছর। এই সময়টাতে পারু একবারের জন্য একটা ফোন পর্যন্ত করলো না।
গ্রীষ্মের এক পড়ন্ত বিকেলে আমি বারান্দায় বসে চা খাচ্ছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম বছর তেরো মত এক কিশোর আমার দিকেই আসছে। ছেলেটা কাছে এসে বিনয়ী গলায় আমাকে জিজ্ঞেস করলো, এটা কি সীমা আন্টিদের বাড়ি?
আমি বললাম, হ্যা। আমি ওনার স্বামী।
কিশোর ছেলেটা লম্বা করে আমাকে একটা সালাম দিলো। পকেট থেকে একটা খাম বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, এখানে একটি চিঠি আছে। পারু আন্টি এই চিঠিটা আপনাকে দিতে বলেছেন।
আমি সালামের উত্তর দিয়ে চিঠিখানি হাতে নিলাম। আমার ভেতরে বিস্ময় সাথে কোতুহল৷ আজকালকার দিনে চিঠির প্রচলন প্রায় নেই বললেই চলে। পারু ফোন করতে পারতো৷ সেটা না করে প্রাচীন পদ্ধতিতে চিঠিতে করে নিজের ভাব লিখে পাঠিয়েছে৷ কি এমন লিখেছে পারু? আমি আর দেরি না করে খামটা ছিড়ে চিঠিখানি বের করলাম।
একটা সাদা কাগজের মাঝখানে শুধুমাত্র দুইটি লাইন লেখা।
সীমা! আমি খুব অসুস্থ।
পারলে আমাকে এসে দেখে যা।
ইতি
পারু।
ছেলেটা তখনো আমার সামনে দাঁড়িয়ে। ঘরের ভেতরে আসার জন্য কত করে বললাম। সে আসলো না। চলে যাওয়ার আগে পারুর বাড়ির ঠিকানাটা দিয়ে গেলো। আর বললো, পারু আন্টি মনে হয় আর বেশিদিন বাচবেন না। মরার আগে আপনাদেরকে দেখতে পেলে অনেক বেশি খুশি হবেন। এখন তিনি প্রায় সারাদিন-ই শুধু আপনাদের কথাই বলেন।
পারুর এমন অসুস্থতার খবরে আমার ভেতরটা কেমন যেন কেদে উঠলো। যতদূর জানতে পেরেছি, পারুর এখনো বিয়ে হয়নি। সে ইচ্ছে করেই কাউকে নিজের জীবনের সাথে জড়ায়নি।
পুরুষ জাতিকে সে নিজের জীবনের চাইতেও অনেক বেশি ঘৃণা করে। তার এই ঘৃনা করার কারনটা আজো পর্যন্ত রহস্যই রয়ে গেলো। কে জানে এখন সেই রহস্যের সমাধান হয়েছে কিনা!
বিকালে কিছু ফলমূল আর সীমাকে সঙ্গে করে বেড়িয়ে পড়লাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগেই পারুর বাসায় এসে পৌছলাম।
পারু এখন আর আগের মত জৌলুশ পূর্ণ বাড়িতে থাকে না। হাতের টাকা পয়সা হয়তো সব ফুড়িয়ে এসেছে৷ আর তাইতো জীবনের এই শেষ সময়টাতে এমন এক বাসায় থাকতে হচ্ছে তাকে৷
ব্যস্ততম শহরের লম্বা একটি ফ্লাইওভারের গোরা থেকে দক্ষিন দিকে একটি ছোট্ট নোংরা গলি চলে গেছে। সেই গলির শেষপ্রান্তে ছোট একটা টিনের খুপড়ি। দূর থেকে এটাকে সংখ্যায় মাত্র একটা দেখায়। কিন্তু ভেতরে গিয়ে আমার মাথা ঘুরে গেলো৷
দেখলাম, সেখানে কয়েকটি পরিবারের বাস। ছোট্ট ছোট্ট কবুতরের খাচার মত ঘর৷ এই একেকটি খোপে এক একটি পরিবারের বাস৷
পারুর ঘরে ঢুকে দেখলাম, সে একটি কাঠের চৌকিতে আড়াআড়িভাবে শুয়ে আছে। চৌকিতে তোষক নেই৷ শক্ত কাঠের উপর একটি ময়লা চাদর৷ সেটিও অগোছালো।
আমাদেরকে দেখা মাত্রই পারু প্রায় কেদে ফেললো। সীমাকে জড়িয়ে ধরে কেদে কেদে বললো, তোরা কিভাবে এত বেঈমান হতে পারলিরে? এতগুলো বছরে আমার কথা কি একবারের জন্যেও মনে হয়নি?
সীমা কিছুই বলতে পারলো না। বোনের সাথে তাল মিলিয়ে ছোট বাচ্চাদের মত কাদতে শুরু করে দিলো। যেমনটা সে বছর কুড়ি আগে কেদেছিলো। আমার ঘরে যখন নতুন বউ হয়ে আসে।
কি যেন এক অজানা মায়ায় আমার দৃষ্টিও ঘোলা হয়ে আসলো। আমি সেই ঘোলাটে নয়নে পারুকে আবিষ্কার করলাম একটি শেকড় বিহীন গাছের মত। একজন অসহায়, অসুস্থ মহিলা। যে পরিস্থিতির ভারে পৌর বয়সে-ই বৃদ্ধা হয়ে গেছে। যার এই সময়ে প্রচন্ড সঙ্গ দরকার, সঙ্গী দরকার সেখানে সে নিঃসঙ্গ৷ তার স্বামী নেই, সন্তান নেই।
আমি পারুর কাছে গিয়ে বসলাম। নরম গলায় জিজ্ঞাসা করলাম, কেমন আছো পারু?
পারু চোখ মুছতে মুছতে উত্তর দিলো, ভালো আছি।
তুমিতো কখনো মিথ্যে বলতে না পারু। তবে আজ কেন এমনটা করছো?
পারু জিজ্ঞেস করলো, কি করছি?
আমি স্পষ্ট দেখছি তুমি ভালো নেই। কিন্তু তুমি তা স্বীকার করছো না।
স্বীকার করে কি আর হবে দুলাভাই? আমি কি আবার সেই সময়টাতে ফিরে যেতে পারবো? যেই সময়টাতে ফিরতে পারলে জীবনের ভুলগুলো শুধরে নিতে পারতাম! আমার কি আর সেই সুযোগ আছে?
আমি কিছু বললাম না। কতক্ষণ চুপ করে রইলাম। সত্যি-ই কি পারুর সেই সুযোগটা নেই? সে কি তার জীবনের সেই সময়টাতে ফিরতে পারবে না? যেই সময়টাতে ফিরতে পারলে পারু নিজের ভুলগুলো ধুয়ে ফেলে শুদ্ধ হয়ে ফিরে আসতে পারতো!
আমি বসে আছি পারুর মাথার উলটো পাশে।
পারুর এমন রুগ্ন, শুকনো মুকখানি দেখে আমার মায়া হচ্ছে৷ কিন্তু এই মায়া প্রকাশ করা যাবে না। প্রকাশ করলে সে ভাববে আমি তার প্রতি করুনার দৃষ্টিতে চেয়ে আছি। এই করুনার চাহনী পারু মোটেও পছন্দ করবে না।
সীমা আমার পাশে বসে আছে। পারুর মাথায় খানিক পর পর হাত বুলাচ্ছে আর চোখের পানি ঝড়াচ্ছে।
তিনজনই বাকরুদ্ধ। কারো মুখে কোন কথা নেই। ক্ষনকতক চললো এভাবেই।
আমি আবারো পারুর দিকে তাকালাম। তার সুখহীন মুখটার দিকে চোখ পড়তেই আরেকবার মনের ভেতরেটা মোচড় দিয়ে উঠলো।
মনের ব্যাথাকে উপশম করে আমি পারুকে ডাকলাম, পারু..
পারু কাতর গলায় জবাব দিয়ে শুধু বললো, কি?
তোমার কি মামুনের কথা মনে আছে? আল মামুন। যার সাথে তোমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো।
পারু জবাব দিলো না। আমি আবারো বললাম, মামুন কিন্তু এখনো প্রায়শই তোমার কথা জিজ্ঞেস করে। তুমি কেমন আছো, বিয়ে হয়েছে কিনা ইত্যাদি।
পারু বিরক্তির স্বরে বললো, কেন এই সময়ে ওসব কথা বলছেন দুলাভাই? আপনি কি আমার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতে এসেছেন?
আমি বুঝতে পারলাম পারু তার অতীতের ভুল নিয়ে অনুতপ্ত। না হলে এমন কথা বলতো না। সে নিশ্চয়ই এখন মামুনের জন্য আফসোস করে। কিন্তু এখন আর আফসোস করে লাভ কি?
কতগুলো বছর আগেকার সেই দিনটিতে আমি কতটা আশা করেই না মামুনকে নিয়ে এসেছিলাম পারুদের বাড়িতে। সেদিন পারু আমার কথা শুনেনি। মামুনকে কি অপমানটাই না করা হয়েছিলো সেদিন। বেচারা বিয়ে করার আশা নিয়ে মেয়ের বাড়িতে এসে শেষমেশ কিনা অপবাদের স্বীকার হলো। পারু সেদিন তাকে বলেছিলো, আপনি একজন নারী লোভী৷ যে কিনা তিনটি মাত্র কথার অধিকারে একটা নারী দেহকে সারাজীবনের জন্য ভোগ করতে চান। আপনার লজ্জা হওয়া উচিত ।
মামুন হয়তো অনেক লজ্জা পেয়েছিলো সেদিন। কিন্তু প্রকৃত অর্থে ঐদিন মামুনের থেকে বেশি অপমানটা কি আমাকে করা হয়নি? আমি-ইতো তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম পারুদের বাড়িতে।
পারু সেদিনের সেই কথা গুলি বলেছিলো ঠিকই। কিন্তু এর পূর্ণ রসদ যুগিয়েছিল তার মা। যিনি আমার শ্বাশুড়ি। তাই এমন মহিলাকে শ্বাশুড়ি হিসেবে পরিচয় দিতে আমার বড় ঘৃণা লাগে।
আজ তিনি পৃথিবীতে বেঁচে নেই। মরার আগে নিজের মেয়েদের সম্পদ বলতে তেমন কিছুই দিয়ে যেতে পারেননি৷ কেননা মৃত্যুর সময় তিনিও ছিলেন সঙ্গীহীন।
যেটা দিয়ে গেছেন সেটা তার শিক্ষা। যেই শিক্ষায় দ্বিক্ষীত হয়ে তার মেয়ে আজ পথের ভিক্ষুকের সামিল।
আজ পারুর একটা সংসার থাকতে পারতো৷ যেই সংসার তার কাছের মানুষ দিয়ে কানায় কানায় ভরে থাকতো৷
পারু এখন একলা চলতে পারেনা। তার পাশে স্বামী নামক ব্যক্তিটি থাকলে হয়তো তাকে একলা চলতে হতো না। একজোড়া বিশ্বস্ত হাত হতে পারতো তার ছায়াসঙ্গী।
কিন্তু পোড়া কপাল তার, আজ সেই বিশ্বস্ত একজোড়া হাতের কতই না অভাব।
এই অভাবটা আমি যেভাবে অনুভব করছি, পারুও কি একইভাবে অনুভব করছে?
হয়তো করছে। পারুর সুখ বিতারিত, শুকনো চোখ মুখের অসহায় চাহনী এমন কিছুরই ইঙ্গিত করছে।
সত্যমনা লেখক -
Monir Hossain.
COMMENTS