পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস বিকৃতি:
১.
অথচ বহিরাগত সেন আমলে বৌদ্ধরা কেমন ছিল তা কিন্তু 'স্বাধীন সেন' উল্লেখ করেননি। অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার দাবি হল: এটা উল্লেখ করলে ওটাও করা। স্বাধীন সেন স্যার নিজ পূর্বপুরুষদের কলঙ্ক গোপন করে চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িকতার পরিচয় দিলেন। নালন্দা বিহারের ধ্বংসের দায় বিজয়সেনের ঘাড় থেকে খলজীর ঘাড়ে তুলে দিলেন।
২.
সুলতানি আমলের কয়েক বছরের মাথায় রাজা গণেশ নামে উগ্র হিন্দু রাজ্যপাট দখল করে। হিন্দুরা যদি এতো অসুবিধায়ই থাকবে, তবে ভাদুরিয়ার জমিদার কাম সুলতানের প্রধান রাজস্ব ও এডমিন কর্মকর্তা কীভাবে গণেশ হয়। গণেশ যেহেতু ক্ষমতা দখল করেছে, সুতরাং আর্মির উল্লেখযোগ্য সদস্য ছিল হিন্দু, প্রশাসনে উল্লেখযোগ্য অংশ হিন্দু থাকতে হবে। নইলে হিন্দু শাসন সম্ভব ছিল না। তাও যে সে শাসন না। পীর বদরুল ইসলাম সহ বহু মুসলমানকে ভোগে দিয়ে দেয়া শাসন।
অর্থাৎ হিন্দুরা ব্যাপক অসুবিধায় ছিল বলে যে ট্রাম্পকার্ড চালানো হয়, তা নিয়ে সংশয় আছে। স্টুয়ার্ট (Charls Stewarts) তাঁর 'History of Bengal' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেনঃ
দেশের বাণিজ্যাদির ওপর শাসকেরা হাত দিতেন না। ইহারা চাষ-আবাদ সম্পর্কেও আদৌ উৎসাহিত ছিলেন না। ধনশালী হিন্দুরাই তখন কৃষিপ্রধান বাংলার একরূপ মালিক ছিলেন [ক] ; শুধু কৃষি নয়, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদিও হিন্দুদের হাতে ছিল। ধনশালী হিন্দুরাই জায়গিরগুলি ইজারা নিতেন এবং এঁরাই ব্যবসা-বাণিজ্যের সমস্ত সুবিধা ভোগ করতেন [খ]।
৩.
বৃটিশরা ১৮৭২ সালে প্রথম আদমশুমারি করেছিল। তারা ধারণা করেছিল পূর্ববঙ্গে হিন্দুরাই গরিষ্ঠ। চিন্তা করেন। সেসময় আর্থসামাজিক রাজনৈতিক দাপট কেমন থাকলে, আর মুসলিমদের অবস্থা কেমন প্রান্তিক থাকলে বৃটিশরা মনে করে হিন্দুরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। পরে দেখা গেল, বেঙ্গল প্রদেশে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাও কত? ৬০%। হিন্দু ৪০%।
১৮৭২ সালে যদি হিন্দু জনগোষ্ঠী থাকে ৪০%, তাহলে সুলতানি আমলে (আরও ৪০০) বছর আগে কত ছিল? সম্ভাবনা এটাই যে, তখন হিন্দুরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ [গ], কেননা ইসলামের দাওয়াতের বয়স তখনও কম।
৩.
তাহলে হিন্দু জনগোষ্ঠীর দখলে কৃষি [মিলান ক], ব্যবসা [খ], সংখ্যা [গ]। দেশের সম্পদ দেশেই থাকতো, মুসলিম শাসকরা পাচার করতো না। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেনঃ এই সময় বাংলা স্বাধীন ছিল। তার ধনসম্পদ দেশের মধ্যেই থাকত। তাই বাংলা ছিল খুবই সম্পদশালী। এই সমৃদ্ধির মূলে ছিল বাংলার শস্য-সম্পদ, শিল্প-বাণিজ্য।❞
অর্থাৎ কৃষি-ব্যবসা-সংখ্যার সুফল ভোগ সংখ্যাগরিষ্ঠই করবে, এটাই স্বাভাবিক।
কেউ প্রমাণ করতে পারবে না, মুসলিমরা হিন্দুদের সম্পদ লুটপাট করেছিল সুলতানি আমলে। তাহলে এই যে মনগড়া কথাবার্তা যে 'মুসলিমরা অনেক বেশি সুবিধায়' (পরোক্ষে হিন্দুরা অনেক বেশি অসুবিধায়), এই কথার ইতিহাসগত ভিত্তি কী? একটা রেফারেন্স দেয়া হোক।
৪.
ইতিহাস এটাই বলে: মোগল বাদশাহরা (এমনকি আওরঙ্গজেবও) এবং মুসলিম নৃপতিরা প্রশাসনিক ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত হিন্দুতোষণ করেছেন। মোটাদাগে সবাই। হিন্দুদের কাছে সবচেয়ে অসহ্য শাসক আওরঙ্গজেবের আমলেই রাজস্ব বিভাগের মতো সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ একচেটিয়া হিন্দুদের দখলে ছিল। সেখানে বাকিদের কী অবস্থা!
নিজেদের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে প্রত্যেকেই হিন্দুশক্তিকে নিজের পাশে পেতে চেয়েছে। শাসক শাসিতের যে সম্পর্ক, তা পুরো মুসলিম ইতিহাসে হিন্দুদের সাথে অনুপস্থিত। এক সেনাপতি কালাপাহাড় (সাবেক হিন্দু) ও গজনীর সুলতান মাহমুদ ছাড়া কেউ শিরক উৎপাটনের বিন্দুমাত্র তাগিদ অনুভব করেনি। এই প্রশ্রয়ের দরুন বার বার হিন্দুত্ববাদের উত্থান ঘটেছে (আকবর, রাজা গণেশ, সিরাজউদ্দৌলার মন্ত্রী জগৎশেঠ-উমিচাঁদ-রায়দূর্লভ)। ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ইসলাম থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছে। কেননা কোনো বাদশাহই নববী দাওয়াতকে (দাওয়াত-জিযিয়া-কিতাল) নিজ মূলনীতি হিসেবে নেয়নি।
আমাকে সময় দিলে আমি পশ্চিমা ও হিন্দু ঐতিহাসিকদের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করে দেব গত ৮০০ বছরের মুসলিম শাসনের ইতিহাস ছিল হিন্দুতোষণের ইতিহাস। আওরঙ্গজেবের পত্রাবলীতেও প্রশাসনিক ক্ষেত্রকে আওরঙ্গজেব রহ. ধর্মনিরপেক্ষ রাখতে বলেছিলেন। তাহলে বাদবাকিদের কী অবস্থা।
এইসব ভুল ইতিহাস শিখিয়ে, 'উপমাহদেশের ইতিহাসের হিন্দুত্ববাদী বয়ান' আমাদের সন্তানদের গেলানো মানে ইসলামের বিরুদ্ধে খোলাখুলি অবস্থান। আমাদের সন্তানদের উপর মনস্তাত্ত্বিক হামলা। শারীরিক হামলা হলে বসে থাকতেন? সরব হোন। নাউ অর নেভার। এদের কোন যোগ্যতা নেই আমাদের শিশুদের শেখানোর।
স্যরি।
COMMENTS